দর্শন— এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই যেন মনের পর্দায় এক অনন্ত বিস্তারের ছবি ভেসে ওঠে। যেন অসীমের সন্ধানে ছুটে চলা এক অক্লান্ত পথিকের পদচারণা। জীবনের গভীরতম প্রশ্নগুলোর সন্ধানে, অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচনে মানুষের এই নিরন্তর যাত্রা, এই-ই তো দর্শন।
আমাদের চারপাশের জগৎটাকে যখন আমরা একটু অন্য চোখে দেখি, প্রতিটি ঘটনার পেছনে যখন একটা কারণ খুঁজি, তখনই যেন দর্শন জেগে ওঠে আমাদের মধ্যে। কে আমরা? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মানুষ ধর্ম, বিজ্ঞান, শিল্প— সবকিছুকেই ছাড়িয়ে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। সেই মাত্রাই দর্শন।
কিন্তু দর্শন কেবল প্রশ্ন করা নয়, উত্তর খোঁজার চেষ্টাও বটে। দার্শনিকরা যুক্তি, তর্ক, চিন্তার মাধ্যমে জীবনের গভীরতম সত্যগুলোকে উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের এই চিন্তা-ভাবনা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, আমাদের চিন্তাকে প্রসারিত করেছে।
দর্শনের বিভিন্ন শাখা
দর্শন এক বিশাল বটবৃক্ষের মতন। এর অনেক শাখা-প্রশাখা। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
- অধিবিদ্যা: এই শাখাটি পরম সত্তার অস্তিত্ব, জগতের উৎপত্তি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
- জ্ঞানতত্ত্ব: এখানে জ্ঞানের প্রকৃতি, জ্ঞানের উৎস, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
- নীতিশাস্ত্র: এই শাখাটি নৈতিক মূল্যবোধ, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
- তত্ত্বমীমাংসা: এখানে বিভিন্ন বিষয়ের তত্ত্ব, তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক, তাদের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এই শাখাগুলো ছাড়াও দর্শনের আরও অনেক শাখা আছে। যেমন, রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক দর্শন, ধর্ম দর্শন, শিল্প দর্শন ইত্যাদি।
দর্শনের প্রয়োজনীয়তা
দর্শন কেন দরকার? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, দর্শন আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। দর্শন আমাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখায়, চিন্তা করতে শেখায়। দর্শনের মাধ্যমে আমরা আমাদের চারপাশের জগৎটাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি, নিজেকে আরও ভালোভাবে জানতে পারি।
দর্শন আমাদেরকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। একটা আদর্শ সমাজের স্বপ্ন, একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এই স্বপ্নগুলোই আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আমাদেরকে নতুন কিছু করার প্রেরণা দেয়।
দর্শনের ভবিষ্যৎ
দর্শনের কোনো শেষ নেই। যতদিন মানুষের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন দর্শনেরও অস্তিত্ব থাকবে। কারণ, মানুষের মনে যতদিন প্রশ্ন জাগবে, ততদিন দর্শনও বেঁচে থাকবে।
আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে দর্শনের ভূমিকা আরও বেড়েছে। বিজ্ঞান যেমন আমাদেরকে জগতের বাইরের রহস্যের সন্ধান দেয়, তেমনি দর্শন আমাদেরকে জগতের ভিতরের রহস্যের সন্ধান দেয়। বিজ্ঞান আর দর্শন— এই দুই মিলেই মানুষের জ্ঞানের পরিধি সম্পূর্ণ হয়।
উপসংহার
দর্শন হলো মানুষের চিন্তার সর্বোচ্চ স্তর। দর্শন আমাদেরকে মানুষ হিসেবে সমৃদ্ধ করে, আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। দর্শন ছাড়া মানুষ যেন একটা পাখি যার ডানা কেটে দেওয়া হয়েছে। সে হয়তো বাঁচতে পারে, কিন্তু উড়তে পারে না। তাই, দর্শনকে আমাদের জীবনের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। তবেই আমরা আমাদের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাব।