ফোমো: আধুনিক যুগের অদৃশ্য শৃঙ্খল

Estimated read time 1 min read

আজ সকালে উঠেই মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মনে হলো, যেন সারা পৃথিবী আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিডে দেখলাম, বন্ধুরা কেউ পাহাড়ে বেড়াতে গেছে, কেউ নতুন চাকরি পেয়েছে, আবার কারও বিয়ে হয়ে গেছে। আর আমি? আমি যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছি একই জায়গায়, একই রুটিনে আটকে। এই অনুভূতি, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’ বা সংক্ষেপে ‘ফোমো’, তা কি শুধু আমারই? নাকি এটা আমাদের সমাজের একটি ব্যাপক ও গভীর সমস্যা?

আমাদের এই বাংলাদেশ, যেখানে একদা মানুষ ছিল প্রকৃতির সাথে একাত্ম, যেখানে জীবনের ছন্দ ছিল নদীর প্রবাহের মতো স্বাভাবিক ও অবিরাম, সেখানে আজ আমরা দেখছি এক নতুন ধরনের উদ্বেগ ও অস্থিরতা। এই উদ্বেগের নাম ফোমো – যা আমাদের মনকে করছে অশান্ত, জীবনকে করছে অসম্পূর্ণতার বোধে ভারাক্রান্ত।

ফোমো কেন এত শক্তিশালী? কারণ এটি আমাদের মৌলিক মানবিক প্রবৃত্তির সাথে জড়িত – সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করার প্রবণতা, এবং জীবনের সর্বোচ্চ সম্ভাবনা অর্জন করার ইচ্ছা। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়া এই প্রবৃত্তিগুলোকে অস্বাভাবিক মাত্রায় উস্কে দিয়েছে।

আমাদের গ্রামের বাড়িতে দাদু বলতেন, “বাছা, জীবন হলো নদীর মতো। কখনও শান্ত, কখনও উত্তাল। কিন্তু সব সময় এগিয়ে যায় নিজের গতিতে।” কিন্তু আজ? আজ আমরা যেন সেই নদীর প্রবাহকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। প্রতিটি মুহূর্তকে করতে চাই অর্থবহ, প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে করতে চাই অনন্য। এই চাওয়া কি স্বাভাবিক? নাকি এটা আমাদের জীবনের ছন্দকে নষ্ট করছে?

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের দিয়েছে অসীম সম্ভাবনার জানালা। কিন্তু সেই জানালা দিয়ে আমরা দেখছি কী? আমরা দেখছি একটি কৃত্রিম, সাজানো-গোছানো জগৎ। যেখানে প্রতিটি ছবি ফিল্টার দিয়ে সাজানো, প্রতিটি স্ট্যাটাস পরিকল্পিত, প্রতিটি ভিডিও সম্পাদিত। এই কৃত্রিম জগতের সাথে নিজেকে তুলনা করে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের জীবনের বাস্তব সৌন্দর্য ও অর্থ।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমরা কীভাবে আনন্দ পেতাম ছোট ছোট জিনিসে। বৃষ্টির পর মাটির গন্ধে, পুকুরে সাঁতার কাটায়, বন্ধুদের সাথে আড্ডায়। সেই আনন্দের মধ্যে ছিল না কোনো তুলনা, কোনো প্রতিযোগিতা। কিন্তু আজ? আজ আমরা প্রতিটি মুহূর্তকে বিচার করছি – এটা কি ইনস্টাগ্রামযোগ্য? এটা কি আমার ফলোয়ারদের কাছে ভালো লাগবে?

ফোমো শুধু ব্যক্তিগত জীবনকেই প্রভাবিত করছে না, এটি আমাদের সামাজিক কাঠামোকেও বদলে দিচ্ছে। আমাদের সমাজে যে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ঐতিহ্য ছিল, তা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগিতার দাপটে। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, জীবনের প্রকৃত অর্থ লুকিয়ে আছে পারস্পরিক সম্পর্কে, সহানুভূতিতে, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধায়।

তবে কি আমরা হতাশ হব? না, তা নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি যেমন সমস্যার উৎস, তেমনি এর সমাধানও হতে পারে। আমাদের শিখতে হবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে আমাদের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আমাদের ফিরে যেতে হবে আমাদের শিকড়ের কাছে, খুঁজে বের করতে হবে সেই সরলতা ও স্বচ্ছতা যা একদা ছিল আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ফোমো’র বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের প্রথমেই স্বীকার করতে হবে যে, জীবনে সবকিছু পাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পথ বেছে নেওয়ার সাথে সাথে আমরা কিছু হারাই। কিন্তু সেই হারানোর মধ্যেও রয়েছে লাভ – আমরা পাই গভীরতা, পাই একাগ্রতা।

দ্বিতীয়ত, আমাদের শিখতে হবে বর্তমান মুহূর্তে বাস করতে। কবি বলেছিলেন, “আজকের দিনটিরে পূর্ণ করি লব।” এই কথাগুলো আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি মুহূর্তকে পূর্ণভাবে উপভোগ করা, তার মধ্যে নিমগ্ন হওয়া – এটাই ফোমো’র সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ।

তৃতীয়ত, আমাদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে আমাদের সফলতার সংজ্ঞা। সফলতা কি শুধু বাহ্যিক অর্জন? নাকি এর মধ্যে রয়েছে আত্মবিকাশ, মানবিক মূল্যবোধের চর্চা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা? আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃত সফলতা আসে নিজের সাথে সঙ্গতি রেখে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে, অন্যের জীবনের সাথে নিজের জীবনকে তুলনা করে নয়।

চতুর্থত, আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটি সহায়ক সামাজিক পরিবেশ। যেখানে মানুষ একে অপরকে উৎসাহিত করবে নিজের পথে এগিয়ে যেতে, যেখানে থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি। এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ নয়, কিন্তু এটি অসম্ভব নয়।

পঞ্চমত, আমাদের শিখতে হবে নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে। আমরা প্রত্যেকেই অনন্য, আমাদের প্রত্যেকের জীবন যাত্রা আলাদা। এই বৈচিত্র্যকে উদযাপন করতে হবে, এর মধ্যে খুঁজে পেতে হবে সৌন্দর্য।

ষষ্ঠত, আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় ধরে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা, দিনে কিছু সময় পুরোপুরি অফলাইন থাকা – এ ধরনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

সপ্তমত, আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবন একটি মহাকাব্যের মতো। এর প্রতিটি অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনো একটি অধ্যায়ই সম্পূর্ণ কাহিনী নয়। আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়কে সম্মান করতে হবে, তার থেকে শিখতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে।

অষ্টমত, আমাদের চর্চা করতে হবে কৃতজ্ঞতা। যা আমাদের আছে, যা আমরা করতে পারি, যা আমরা অর্জন করেছি – এ সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞ থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কৃতজ্ঞতা আমাদের মনকে করে শান্ত, আমাদের দৃষ্টিকে করে প্রশস্ত।

নবমত, আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। কেন আমরা বেঁচে আছি? কী আমাদের জীবনের লক্ষ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে আমরা পাব একটি দিকনির্দেশনা, যা আমাদের সাহায্য করবে ফোমো’র প্রভাব কাটিয়ে উঠতে।

দশমত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জীবনের সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্যে। প্রতিটি ব্যক্তির জীবন একটি অনন্য শিল্পকর্ম, যা তার নিজস্ব রঙে ও ছন্দে সাজানো। অন্যের জীবনের সাথে নিজের জীবনকে তুলনা করে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের জীবনের অনন্য সৌন্দর্য।

এই দশটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমরা ধীরে ধীরে ফোমো’র প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারব। কিন্তু এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার জন‍্য প্রয়োজন ধৈর্য ও দৃঢ়তা। মনে রাখতে হবে, আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানে ফোমো একটি বাস্তবতা। এটি এমন একটি মানসিকতা যা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।

তবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব নয়। আমাদের প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলন, যা আমাদের মূল্যবোধকে পুনর্নির্ধারণ করবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, সবকিছুতেই এই পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের শিশুদের শেখাতে হবে যে, জীবনের প্রকৃত মূল্য নিহিত আছে অন্তরের শান্তিতে, মানবিক সম্পর্কের গভীরতায়, নিজের সাথে সৎ থাকার সাহসে।

আমাদের সমাজে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেখানে মানুষ নিজের জীবনের গল্প নিয়ে গর্বিত হবে, অন্যের সাফল্যে আনন্দিত হবে, নিজের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে। যেখানে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা হবে মূল চালিকাশক্তি। যেখানে মানুষ বুঝবে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত একটি উপহার, এবং সেই উপহারকে সম্মান করাই প্রকৃত জ্ঞান।

ফোমো’র বিরুদ্ধে এই লড়াই শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে আমাদের প্রত্যেককে অংশ নিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজের জীবনে এই পরিবর্তন আনা, এবং সেই পরিবর্তনের প্রভাব ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের চারপাশে।

মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু সেই সাথে জটিলও করেছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো এই জটিলতার মধ্যে সরলতা খুঁজে বের করা, এই দ্রুত গতির মধ্যে স্থিরতা খুঁজে নেওয়া। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য, না কি আমরা প্রযুক্তিকে আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেব।

ফোমো’র বিরুদ্ধে লড়াই করার অর্থ জীবনের প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবন হবে একটি যাত্রা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি অভিজ্ঞতা মূল্যবান। যেখানে আমরা থাকব বর্তমানে নিবদ্ধ, ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন নয়। যেখানে আমরা বুঝব, জীবনের সৌন্দর্য তার অনিশ্চয়তায়, তার অপ্রত্যাশিত মুহূর্তগুলোতে।

তবে এই পরিবর্তন সহজ নয়। এর জন‍্য প্রয়োজন সচেতন প্রয়াস, নিরন্তর অনুশীলন। প্রতিদিন আমাদের নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, আমরা যেখানে আছি, যা করছি, তা-ই যথেষ্ট। প্রতিদিন আমাদের চর্চা করতে হবে কৃতজ্ঞতা, সহানুভূতি, ও আত্ম-স্বীকৃতি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবন একটি মহাকাব্য, যার প্রতিটি অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ। কখনও আমরা থাকব কাহিনীর নায়ক, কখনও সহায়ক চরিত্র। কখনও আমরা জয়ী হব, কখনও পরাজিত। কিন্তু এসব কিছুর মধ্য দিয়েই আমরা গড়ে তুলব আমাদের জীবনের অনন্য কাহিনী।

ফোমো’র বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্য দিয়ে আমরা আবিষ্কার করব জীবনের প্রকৃত অর্থ। আমরা বুঝব, সত্যিকারের সুখ অন্যের জীবনের সাথে নিজেকে তুলনা করে আসে না, বরং আসে নিজের জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে। আমরা উপলব্ধি করব, জীবনের প্রকৃত সম্পদ হল আমাদের সম্পর্ক, আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের স্মৃতি।

শেষ পর্যন্ত, ফোমো’র বিরুদ্ধে লড়াই হল নিজের সাথে সৎ থাকার লড়াই। এটি একটি যাত্রা যা আমাদের নিয়ে যায় আমাদের অন্তরের গভীরে, যেখানে আমরা খুঁজে পাই আমাদের প্রকৃত সত্তা। এই যাত্রায় আমরা শিখি নিজেকে ভালোবাসতে, নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে, নিজের অনন্যতাকে উদযাপন করতে।

তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে শুরু করি এই যাত্রা। আসুন, আমরা মুক্ত করি নিজেদেরকে ফোমো’র শৃঙ্খল থেকে। আসুন, আমরা গড়ে তুলি এমন একটি সমাজ যেখানে প্রত্যেকে নিজের জীবনের নায়ক, যেখানে প্রত্যেকের কাহিনী অনন্য ও মূল্যবান। কারণ শেষ পর্যন্ত, জীবন হল একটি উপহার, এবং এই উপহারকে পূর্ণভাবে উপভোগ করাই আমাদের কর্তব্য ও অধিকার।

You May Also Like