বাবারা যখন দুর্নীতি করে

Estimated read time 1 min read

সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোয় ঢাকার রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে আসছিল। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে রহিমের মনে হলো, এই শহরটা যেন একটা বিশাল জালের মতো। প্রতিটি সুতোয় জড়িয়ে আছে কত মানুষের জীবন, কত স্বপ্ন, কত আশা-নিরাশা। কিন্তু সেই জালের মাঝেই লুকিয়ে আছে এমন কিছু সুতো, যা দেখতে সুন্দর কিন্তু স্পর্শ করলেই হাত কেটে যায়।

রহিম একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা একটি সরকারি অফিসে চাকরি করেন। ছোটবেলা থেকেই রহিম শুনে এসেছে যে তার বাবা খুব সৎ মানুষ, কখনও ঘুষ নেন না, দুর্নীতি করেন না। এই গর্বই ছিল রহিমের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু আজ সকালে যা ঘটেছে, তাতে সেই গর্বের ভিত্তি যেন কেঁপে উঠেছে।

সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাবা যখন চা খাচ্ছিলেন, তখন রহিম দেখলো তার মুখে একটা অদ্ভুত উদ্বেগের ছায়া। বাবা বললেন, “দেখো বাবা, আজ অফিসে একটা বড় টেন্ডার হবে। বস বলেছেন, এবার নাকি আমাদেরও কিছু পাওয়া হবে।” রহিম প্রথমে বুঝতে পারেনি বাবার কথার তাৎপর্য। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝলো, তখন তার মনে হলো যেন কেউ তার বুকের ভেতর একটা পাথর চাপা দিয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে রহিমের মনে পড়লো তার ছোটবেলার কথা। স্কুলে যখন সবাই নতুন জুতো, নতুন ব্যাগ নিয়ে আসতো, তখন সে বাবার কাছে চাইতো। বাবা বলতেন, “দেখো বাবা, আমরা গরিব। কিন্তু আমরা সৎ। এই সততাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।” সেই কথাগুলো রহিমের কানে এখনও বাজছে। কিন্তু আজ সেই কথাগুলোর সাথে মিশে যাচ্ছে বাবার সকালের কথা।

বাড়িতে ঢুকতেই মা এসে বললেন, “কী রে, তোর বাবা এখনও ফেরেনি? আজ নাকি অফিসে কোনো বড় কাজ ছিল।” রহিম চুপ করে রইলো। কী বলবে সে? বলবে কি যে তার বাবা, যাকে সে এতদিন সততার প্রতীক হিসেবে দেখে এসেছে, সেই বাবাও হয়তো আজ দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়েছেন?

রাত গভীর হলো। বাবা এখনও ফেরেননি। রহিম ঘুমাতে পারছে না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে আছে বাইরের অন্ধকারের দিকে। মনে পড়ছে গত সপ্তাহে দেখা একটা খবর। একজন সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। সেই খবর দেখে বাবা বলেছিলেন, “দেখলে? এভাবেই দেশটা নষ্ট হচ্ছে। যারা দেশের সেবা করার জন্য দায়িত্ব পেয়েছে, তারাই যদি এভাবে দুর্নীতি করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?”

রহিম ভাবছে, আজ যদি তার বাবাও সেই একই পথে পা বাড়ান, তাহলে কী হবে? কেমন করে সে মুখোমুখি হবে বাবার? কী বলবে তাকে?

রাত প্রায় এগারোটায় বাবা ফিরলেন। রহিম দেখলো, বাবার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। যেন কিছু একটা পেয়ে গেছেন। রহিমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।

পরদিন সকালে। রহিম দেখলো বাবা খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, আজ এত তাড়া কেন?”

বাবা হাসলেন। বললেন, “আজ অফিসে একটা বড় মিটিং আছে। কালকের টেন্ডারের ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

রহিম আর থাকতে পারলো না। বললো, “বাবা, কাল যে টেন্ডারের কথা বলছিলেন, সেটা কি…”

বাবা রহিমের দিকে তাকালেন। তার চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি। বললেন, “তুমি কী বলতে চাও রহিম?”

রহিম গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো, “বাবা, আপনি কি… মানে… আপনি কি কোনো অন্যায় করেছেন?”

বাবার মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “রহিম, তুমি কি জানো, গত মাসে তোমার মায়ের অপারেশনের জন্য আমি কোথা থেকে টাকা যোগাড় করেছিলাম?”

রহিম চুপ করে রইলো।

বাবা আবার বললেন, “আমি জানি, তুমি আমাকে সততার প্রতীক হিসেবে দেখে এসেছো। কিন্তু বাবা, এই সমাজে, এই ব্যবস্থায় শুধু সৎ থেকে টিকে থাকা কঠিন। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু…”

রহিম অবাক হয়ে শুনছিল বাবার কথা। তার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তার বাবা নন, একজন অচেনা লোক।

বাবা আবার বলতে শুরু করলেন, “দেখো রহিম, আমি জানি তুমি এখন কী ভাবছো। কিন্তু তুমি এখনও ছোট। জীবনের বাস্তবতা কী, তা তুমি জানো না। আমি যা করছি, তা শুধু আমাদের পরিবারের জন্য। তোমার পড়াশোনার জন্য, তোমার মায়ের চিকিৎসার জন্য…”

রহিম আর শুনতে পারলো না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার ছোটবেলার সেই দিনগুলো, যখন বাবা তাকে সততার পাঠ পড়াতেন। সেই বাবা আজ নিজেই সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।

রহিম ভাবছিল, এই সমাজে কি সত্যিই সৎ থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব? নাকি এটা শুধু একটা অজুহাত, যা আমরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য ব্যবহার করি?

সেদিন সন্ধ্যায় রহিম বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লো। সে জানে না কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, সে যেন একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধানে বেরিয়েছে। এমন একটা পৃথিবী, যেখানে বাবারা দুর্নীতি করে না, যেখানে সততা শুধু একটা শব্দ নয়, বরং জীবনের মূলমন্ত্র।

পথে হাঁটতে হাঁটতে রহিম ভাবছিল, আজ তার বাবা যে পথ বেছে নিয়েছেন, সেই পথে হাঁটলে কি সত্যিই জীবন সহজ হয়ে যায়? নাকি সেই সহজ পথের শেষে আছে আরও বড় কোনো দুঃখ, যা এখন থেকে দেখা যায় না?

রহিম জানে, তার সামনে এখন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সে কি তার বাবার পথ অনুসরণ করবে, নাকি নিজের বিবেকের কাছে সৎ থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সে হাঁটছিল শহরের রাস্তায়। চারপাশে লোকজনের ভিড়, গাড়ির হর্ন, দোকানপাটের – সবকিছু যেন তাকে বলছে, জীবন সহজ নয়, কিন্তু সেই কঠিন পথেই লুকিয়ে আছে আসল সুখ।

রাত গভীর হলো। রহিম ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরছে। তার মনে হচ্ছে, আজ রাতে সে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা শুধু তার নিজের জীবনকে নয়, হয়তো আরও অনেকের জীবনকে প্রভাবিত করবে। কারণ প্রতিটি মানুষের সিদ্ধান্তই তো গড়ে তোলে সমাজের ভবিষ্যৎ।

বাড়িতে ফিরে রহিম দেখলো, বাবা বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর চোখে চিন্তার ছায়া। রহিমকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

“এতক্ষণ কোথায় ছিলে?” বাবার কণ্ঠে উদ্বেগ।

রহিম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। বললো, “বাবা, আমি ভেবেছি।”

বাবা অবাক হয়ে তাকালেন। “কী ভেবেছো?”

রহিম গভীর শ্বাস নিয়ে বললো, “বাবা, আপনি সারাজীবন আমাকে শিখিয়েছেন সৎ থাকতে। আজ যদি আপনি সেই পথ থেকে সরে যান, তাহলে আমি কার কাছে শিখবো সততার পাঠ?”

বাবার চোখে জল এসে গেল। তিনি ধীরে ধীরে বসে পড়লেন চেয়ারে। রহিম দেখলো, বাবার কাঁধ কাঁপছে।

রহিম আবার বললো, “বাবা, আমি জানি জীবন কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন পথেই তো আমরা শিখি, বড় হই। আপনি যদি আজ এই সহজ পথ বেছে নেন, তাহলে আমি কীভাবে শিখবো জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে?”

বাবা মুখ তুললেন। তাঁর চোখে অশ্রু। বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো রহিম। আমি ভুল করেছি। আমি ভেবেছিলাম, এই পথেই হয়তো তোমাদের জন্য কিছু করতে পারবো। কিন্তু আসলে এভাবে আমি তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিচ্ছিলাম।”

রহিম বাবার পাশে বসলো। বললো, “বাবা, আমরা একসঙ্গে লড়বো। হয়তো কষ্ট হবে, হয়তো অনেক কিছু ছাড়তে হবে। কিন্তু আমরা জানি, আমরা সঠিক পথে আছি।”

বাবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “আমি গর্বিত তোমাকে নিয়ে, রহিম। তুমি আমাকে ফিরিয়ে এনেছো সেই পথে, যে পথ থেকে আমি বিচ্যুত হয়েছিলাম।”

সেই রাতে রহিম বুঝলো, সততা শুধু একটা শব্দ নয়, এটা একটা শক্তি। এমন একটা শক্তি, যা মানুষকে ভেতর থেকে বদলে দিতে পারে।

পরদিন সকালে। বাবা অফিসে যাওয়ার আগে রহিমকে ডাকলেন। বললেন, “আজ আমি অফিসে গিয়ে সব কিছু স্বীকার করে নেব। হয়তো চাকরি যাবে, হয়তো আরও অনেক কিছু হারাতে হবে। কিন্তু আমি জানি, তোমার মতো ছেলে আছে আমার পাশে।”

রহিম বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, “আমি গর্বিত আপনাকে নিয়ে, বাবা।”

সেদিন থেকে রহিমের জীবনে অনেক কিছু বদলে গেল। বাবার চাকরি চলে গেল। পরিবারে এলো আর্থিক সংকট। কিন্তু রহিম দেখলো, সেই সংকটের মধ্যেও তাদের পরিবারে এসেছে এক অদ্ভুত শান্তি। আর সেই শান্তির উৎস ছিল সততা, যা তারা হারিয়ে ফেলতে বসেছিল।

বছর কয়েক পর। রহিম এখন একজন সফল ব্যবসায়ী। তার ব্যবসার মূলমন্ত্র – সততা। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে সে তার বাবার ছবির সামনে দাঁড়ায়। মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা, যেদিন সে তার বাবাকে ফিরিয়ে এনেছিল সঠিক পথে।

রহিম জানে, আজও অনেক বাবা আছেন যারা দুর্নীতির পথে হাঁটছেন। কিন্তু সে আশা করে, একদিন সবাই বুঝবে, সততার পথে হাঁটাই আসল জয়। কারণ সেই পথেই লুকিয়ে আছে মানুষের প্রকৃত মুক্তি, প্রকৃত আনন্দ।

সন্ধ্যা নামছে ঢাকার আকাশে। অফিস থেকে ফেরার পথে রহিম তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। দেখছে শহরের ব্যস্ততা, মানুষের ছুটোছুটি। ভাবছে, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একজন রহিম, যে চায় সঠিক পথে হাঁটতে। শুধু প্রয়োজন একটু সাহসের, একটু আত্মবিশ্বাসের।

গাড়ি থেকে নেমে রহিম হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে। পথে দেখলো, একটি ছোট ছেলে তার বাবার হাত ধরে হাঁটছে। রহিম হাসলো। ভাবলো, হয়তো এই ছেলেটিও একদিন তার বাবাকে ফিরিয়ে আনবে সঠিক পথে। কারণ প্রতিটি প্রজন্মের দায়িত্ব হলো আগের প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া সেই মূল্যবোধের কথা, যা তারা ভুলে যেতে বসেছে।

বাড়িতে ঢুকতেই রহিমের ছোট মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। রহিম মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ভাবলো, এই তো সেই সম্পদ, যার জন্য সততার পথে হাঁটা। এই নিষ্পাপ মুখের হাসি, এই নির্মল ভালোবাসা – এর চেয়ে বড় সম্পদ আর কী হতে পারে?

রাত নামলো। রহিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ভাবছে, প্রতিটি তারা যেন একেকটি আলোকবর্তিকা। তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্ধকারের মধ্যেও আলো জ্বলে। ঠিক তেমনি, যত অন্ধকারই নেমে আসুক সমাজে, সততার আলো সবসময় জ্বলবে। শুধু প্রয়োজন সেই আলোকে ধরে রাখার সাহস।

রহিম জানে, আগামীকাল আবার নতুন দিন। নতুন করে লড়াই। কিন্তু সে প্রস্তুত। কারণ তার সঙ্গে আছে তার বাবার শেখানো সেই অমূল্য শিক্ষা – সততার পথেই আসল জয়।

#কল্প-কাহিনী

You May Also Like